সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন | ইয়োব

“আমি আপন বিশ্বস্ততা ত্যাগ করিব না”

“আমি আপন বিশ্বস্ততা ত্যাগ করিব না”

 কল্পনা করুন, একজন ব্যক্তি মাটিতে বসে রয়েছেন। তার শরীর, মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিভিন্ন যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়া ও ঘায়ে ভর্তি। তিনি কুঁজো হয়ে, মাথা নীচু করে বসে রয়েছেন আর তার গায়ে কোনো শক্তি নেই। এমনকী তার গায়ে যখন মাছি বসছে, সেটাও তার তাড়ানোর শক্তি নেই। তিনি এতটাই শোকের মধ্যে আছেন যে, তিনি ছাইয়ের উপর বসে রয়েছেন আর নিজের শরীরের ঘাগুলো মাটির পাত্রের একটা ভাঙা টুকরো দিয়ে ঘষছেন। তিনি আগে একজন সম্মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু এখন তাকে কেউ সম্মান করে না। এমনকী তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সবাই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। লোকেরা ও ছোটো ছেলে-মেয়েরাও তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। তাই তিনি মনে করেন, তার ঈশ্বর যিহোবাও হয়তো তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু, আসলে এমনটা ছিল না।—ইয়োব ২:৮; ১৯:১৮, ২২.

 এই ব্যক্তি হলেন ইয়োব। ঈশ্বর তার বিষয়ে বলেছিলেন: “তাহার তুল্য . . . পৃথিবীতে কেহই নাই।” (ইয়োব ১:৮)শত শত বছর পরও ঈশ্বর ইয়োবকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখেছিলেন, যিনি অসাধারণ উপায়ে ধার্মিকতা প্রদর্শন করেছিলেন।—যিহিষ্কেল ১৪:১৪, ২০.

 আপনি কি দুঃখকষ্টের মধ্যে রয়েছেন? যদি থাকেন, তা হলে ইয়োবের কাহিনি পড়ে আপনি প্রচুর সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন। এ ছাড়া, ইয়োবের কাহিনিতে আপনি এমন একটা গুণ সম্বন্ধে শিখতে পারেন, যে-গুণ ঈশ্বরের প্রত্যেক দাসের দেখানো প্রয়োজন আর তা হল, বিশ্বস্ততা। মানুষ এই বিশ্বস্ততা গুণটা সেই সময় দেখায়, যখন ঈশ্বরের প্রতি তাদের এতটাই ভক্তি থাকে যে, চরম পরীক্ষার মধ্যেও তারা তাঁর ইচ্ছা পালন করার জন্য যথাসাধ্য করে। আসুন, আমরা এই বিষয়ে ইয়োবের কাছ থেকে আরও শিখি।

ইয়োব যা জানতেন না

 এমনটা মনে করা হয় যে, ইয়োবের মৃত্যুর কিছুসময় পর, বিশ্বস্ত পুরুষ মোশি ইয়োবের জীবনকাহিনি লিখেছিলেন। মোশি ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করে পৃথিবীতে ইয়োবের জীবনে যা যা ঘটেছিল, তা লিখেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, মোশি এমন কিছু ঘটনা সম্বন্ধেও লিখেছিলেন, যেগুলো স্বর্গে ঘটেছিল।

 ইয়োবের জীবনকাহিনির শুরুর দিকে দেখা যায় যে, তিনি খুবই সুখী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ধনী ছিলেন এবং লোকে তাকে ভালোভাবে জানত ও সম্মান করত। তিনি ঊষ নগরে বাস করতেন, যেটা সম্ভবত বর্তমান সময়ের আরব দেশের উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। এ ছাড়া, তিনি একজন উদার ব্যক্তি ছিলেন আর কষ্টে রয়েছে এমন ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য তিনি এগিয়ে যেতেন। ইয়োব ও তার স্ত্রীর ১০ জন সন্তান ছিল। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হল, ইয়োব যিহোবার সঙ্গে তার সম্পর্ককে খুবই মূল্যবান হিসেবে দেখতেন। তিনি যিহোবাকে খুশি করার জন্য যথাসাধ্য করতেন, ঠিক যেমনটা তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় অব্রাহাম, ইস্‌হাক, যাকোব ও যোষেফ করেছিলেন। সেই কূলপতিদের মতো তিনিও তার পরিবারের জন্য যাজক হিসেবে কাজ করতেন আর নিজের সন্তানদের হয়ে বলি উৎসর্গ করতেন।—ইয়োব ১:১-৫; ৩১:১৬-২২.

 হঠাৎই ইয়োবের জীবনকাহিনিতে আমরা স্বর্গের এক দৃশ্য দেখতে পাই। স্বর্গে এমন কিছু বিষয় ঘটেছিল, যেগুলো সম্বন্ধে ইয়োব কোনোভাবেই জানতে পারতেন না। ঈশ্বরের বিশ্বস্ত স্বর্গদূতেরা তাঁর সামনে একত্রিত হয়েছিল আর সেখানে বিদ্রোহী শয়তানও প্রবেশ করেছিল। যিহোবা জানতেন, শয়তান ইয়োবকে ঘৃণা করে কারণ ইয়োব একজন ধার্মিক ব্যক্তি। আর তাই, যিহোবার প্রতি ইয়োবের যে-অটুট বিশ্বস্ততা রয়েছে, সেই বিষয়ে তিনি শয়তানের সামনে উল্লেখ করেন। উলটে শয়তান যিহোবাকে প্রশ্ন করে: “ইয়োব কি বিনা লাভে ঈশ্বরকে ভয় করে? তুমি তাহার চারিদিকে, তাহার বাটীর চারিদিকে ও তাহার সর্ব্বস্বের চারিদিকে কি বেড়া দেও নাই?” শয়তান সেই ব্যক্তিদের ঘৃণা করে, যারা বিশ্বস্ততা দেখায়। যখন তারা যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি মনে-প্রাণে ভক্তি দেখায়, তখন তারা প্রমাণ করে যে, শয়তান হল একজন বিশ্বাসঘাতক এবং সে কাউকে ভালোবাসে না। তাই, শয়তান দাবি করেছিল যে, ইয়োব কেবল নিজের স্বার্থের জন্যই ঈশ্বরের সেবা করেন। আর সে এও দাবি করেছিল যে, ইয়োব যদি তার সমস্ত কিছু হারিয়ে ফেলেন, তা হলে ইয়োব যিহোবার সামনেই তাঁর নিন্দা করবেন।—ইয়োব ১:৬-১১.

 যিহোবা ইয়োবকে এক বিশেষ সুযোগ দিয়েছিলেন আর তা হল শয়তানকে ভুল বলে প্রমাণিত করা। কিন্তু, এই ব্যাপারে ইয়োব কিছুই জানতেন না। যিহোবা শয়তানকে ইয়োবের সমস্ত কিছু কেড়ে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পাশাপাশি, তিনি এও বলেছিলেন যে, সে যেন ইয়োবকে স্পর্শ না করে। আর এরপর, শয়তান তার নির্দয় কাজ করতে শুরু করে। একই দিনের মধ্যেই ইয়োবের উপর একের-পর-এক ঝড় বয়ে যায়। তিনি হঠাৎই জানতে পারেন, তার সমস্ত গবাদি পশু, গাধা, মেষ এবং উট মরে গিয়েছে। এ ছাড়া, তিনি এও জানতে পারেন যে, যারা সেই পশুপালের যত্ন নিত, তারাও মারা গিয়েছে। আর যে-ব্যক্তি মেষপালের মৃত্যুর খবর দিতে এসেছিল, তিনি বলেছিলেন, “ঈশ্বরের অগ্নি” নেমে অর্থাৎ সম্ভবত বজ্রপাত হয়ে সেগুলো মরে গিয়েছে। ইয়োবের জীবনে যে কতটা চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা বুঝে ওঠার আগেই তিনি সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা পান। তার ১০ জন সন্তান তার বড়ো ছেলের বাড়িতে একত্র হয়েছিল আর হঠাৎ একটা ঝোড়ো বাতাস এসে তাদের বাড়িতে আঘাত করে, সেই বাড়ি ভেঙে পড়ে যায় এবং তারা সবাই মারা যায়!—ইয়োব ১:১২-১৯.

 ইয়োব যে কতটা চরম কষ্ট অনুভব করেছিলেন, তা হয়তো আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারব না। তিনি তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, তার মাথার সমস্ত চুল কেটে ফেলেছিলেন আর অসহায় হয়ে মাটিতে বসে পড়েছিলেন। তিনি যুক্তি করেছিলেন, ঈশ্বরই তাকে সমস্ত কিছু দিয়েছেন আর ঈশ্বরই সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছেন। শয়তান চতুরতার সঙ্গে এমনভাবে সমস্ত কিছু করেছিল যেন দেখে মনে হয় যে, ঈশ্বরই আসলে ইয়োবের প্রতি এই সমস্ত কিছু ঘটিয়েছেন। এত কিছু সত্ত্বেও শয়তান যেমনটা বলেছিল, তেমনটা ঘটেনি। ইয়োব ঈশ্বরনিন্দা করেননি। এর বিপরীতে তিনি বলেছিলেন: “সদাপ্রভুর নাম ধন্য হউক।”—ইয়োব ১:২০-২২.

ইয়োব জানতেন না যে, শয়তান ঈশ্বরের সামনে তার বিষয়ে খারাপ কথা বলছে

“সে অবশ্য . . . তোমাকে জলাঞ্জলি দিবে”

 শয়তান এত কিছু করার পরও যখন সফল হয় না, তখন সে অত্যন্ত রেগে যায়। সে আবার যিহোবার সামনে যায়, যেখানে সমস্ত স্বর্গদূত একত্র হয়েছিল। যিহোবা ইয়োবের প্রশংসা করেন কারণ শয়তান ইয়োবের উপর অনেক পরীক্ষা এনেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইয়োব নিজের বিশ্বস্ততা বজায় রেখেছিলেন। শয়তান উত্তর করে বলল: “চর্ম্মের জন্য চর্ম্ম, আর প্রাণের জন্য লোক সর্ব্বস্ব দিবে। কিন্তু তুমি এক বার হস্ত বিস্তার করিয়া তাহার অস্থি ও মাংস স্পর্শ কর, সে অবশ্য তোমার সম্মুখেই তোমাকে জলাঞ্জলি দিবে।” শয়তান পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত ছিল যে, ইয়োব যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা হলে তিনি ঈশ্বরনিন্দা করবেন। কিন্তু, ইয়োবের প্রতি যিহোবার পূর্ণ আস্থা ছিল আর তাই তিনি শয়তানকে অনুমতি দেন যে, সে ইয়োবকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। তবে, শয়তান ইয়োবকে মেরে ফেলতে পারত না।—ইয়োব ২:১-৬.

 এরপর, ইয়োব শারীরিক যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করেন, যেমনটা এই প্রবন্ধের শুরুর অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একটু তার স্ত্রীর কথা চিন্তা করুন। তিনি সবেমাত্র তার ১০ জন সন্তানকে হারিয়েছেন আর এবার তিনি দেখছেন যে, তার স্বামীও প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছেন! আর এই ব্যাপারে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। তাই, এই পরিস্থিতি নিয়ে তিক্তবিরক্ত হয়ে ইয়োবের স্ত্রী তাকে বলেন: “তুমি কি এখনও তোমার সিদ্ধতা [“বিশ্বস্ততা,” NW] রক্ষা করিতেছ? ঈশ্বরকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রাণত্যাগ কর।” ইয়োব তার কথা শুনে খুবই অবাক হয়ে যান কারণ সাধারণত তার স্ত্রী কখনো এভাবে কথা বলতেন না। ইয়োব এই উপসংহারে আসেন যে, তার স্ত্রীর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও, ইয়োব ঈশ্বরনিন্দা করেন না। তিনি যা কিছু বলেন, সেগুলোর মাধ্যমে কোনোভাবেই যিহোবার বিরুদ্ধে কোনো পাপ করেন না।—ইয়োব ২:৭-১০.

 আপনি কি জানেন, এই বাস্তব ও কষ্টকর কাহিনির সঙ্গে আপনিও জড়িত রয়েছেন? লক্ষ করুন, এখানে শয়তান শুধুমাত্র ইয়োবের বিরুদ্ধে নয় বরং প্রত্যেক মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল। সে বলেছিল: “প্রাণের জন্য লোক সর্বস্ব দিবে।” অন্যভাবে বললে, শয়তান মনে করে যে, আমাদের মধ্যে কেউই বিশ্বস্ততা বজায় রাখতে পারবে না! সে দেখাতে চায় যে, ঈশ্বরের প্রতি আপনার যে-ভালোবাসা রয়েছে, সেটা প্রকৃত নয় বরং সমস্যা এলেই আপনি তাঁকে ছেড়ে দেবেন। আসলে শয়তান বলতে চায়, আপনিও তার মতো স্বার্থপর! আপনি কি তাকে ভুল বলে প্রমাণিত করতে চাইবেন? আমাদের প্রত্যেকের কাছেই তা করার সুযোগ রয়েছে। (হিতোপদেশ ২৭:১১) আসুন দেখি, এরপর ইয়োবের জীবনে আর কোন সমস্যা দেখা দেয়।

তিন জন ব্যক্তি সান্ত্বনা দিতে ব্যর্থ হন

 তিন জন ব্যক্তি ইয়োবের চরম কষ্টের বিষয়ে জানতে পারেন আর তার সঙ্গে দেখা করতে এবং তাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন। বাইবেল তাদের ইয়োবের মিত্র বলে উল্লেখ করে। তারা ইয়োবকে দূর থেকে দেখে চিনতেই পারেন না। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তার শরীরের চামড়া ঘায়ের কারণে কালো হয়ে গিয়েছে, তার স্বাস্থ্য পুরোপুরি খারাপ হয়ে গিয়েছে। এই তিন জন ব্যক্তি হলেন ইলীফস, বিল্‌দদ ও সোফর। তারা এমন দেখান যেন ইয়োবের জন্য তারা খুবই দুঃখিত। তারা জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করেন আর নিজেদের মাথায় ধুলো দেন। তারা ইয়োবের পাশে মাটিতে গিয়ে বসেন কিন্তু কিচ্ছু বলেন না। তারা সারা সপ্তাহ, দিন-রাত সেখানে বসে থাকেন কিন্তু একটা কথাও তাদের মুখ থেকে বের হয় না। আমরা যেন মনে না করি যে, এই ব্যক্তিরা ইয়োবকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য চুপ করে আছেন। কারণ তারা তাকে কোনো কথাই জিজ্ঞেস করেন না। ইয়োবকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে, তিনি খুব কষ্টের মধ্যে রয়েছেন আর তারা এটা জেনেই সন্তুষ্ট থাকেন আর তার বিষয়ে কোনো কথাই জানতে চান না।—ইয়োব ২:১১-১৩; ৩০:৩০.

 অবশেষে, ইয়োব কথা বলতে শুরু করেন। কষ্টের মধ্যে তিনি যে-দিন জন্মেছিলেন, সেই দিনকে অভিশাপ দিতে শুরু করেন। এ ছাড়া, তিনি এও প্রকাশ করেন যে, তিনি কেন প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে রয়েছেন। তিনি মনে করছেন, ঈশ্বরই হয়তো তার উপর এত সমস্যা এনেছেন! (ইয়োব ৩:১, ২, ২৩) এর অর্থ এই নয় যে, ইয়োব ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। আসলে, তার প্রচুর সান্ত্বনার প্রয়োজন রয়েছে আর যখন তার মিত্রেরা কথা বলতে শুরু করেন, তখন ইয়োবের মনে হয়, তারা যখন চুপ ছিলেন, সেটাই ভালো ছিল।—ইয়োব ১৩:৫.

 প্রথমে ইলীফস কথা বলতে শুরু করেন। তিনি সম্ভবত সেই তিন জন ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিলেন আর হতে পারে, ইয়োবের চেয়েও তার বয়স বেশি ছিল। আর তার পরে পরে অন্য দু-জন ব্যক্তিও ঠিক তার মতোই কথা বলতে শুরু করেন। তাদের কথা শুনে প্রথমে হয়তো মনে হতে পারে যে, সেগুলো খুব-একটা খারাপ নয়। কারণ তারা এমন বিষয়গুলো তুলে ধরছিলেন, যেগুলো ঈশ্বর সম্বন্ধে অনেক লোকই বলে থাকে আর যেগুলোকে লোকেরা সঠিক বলে মনে করে। যেমন তারা বলেন যে, ঈশ্বর হলেন খুবই উচ্চ আর তিনি যারা ভালো কাজ করে, তাদের পুরস্কার দেন আর যারা খারাপ কাজ করে, তাদের শাস্তি দেন। প্রথম থেকেই তাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল যে, ইয়োবের প্রতি তারা কোনো দয়া দেখাচ্ছেন না। ইলীফস যুক্তি করার চেষ্টা করেন যে, ইয়োব যেহেতু এত কষ্টের মধ্যে রয়েছেন, তা হলে এর অর্থ কি এই নয় যে, তিনি নিশ্চয়ই কোনো খারাপ কাজ করেছেন আর এর জন্যই শাস্তি ভোগ করছেন?—ইয়োব ৪:১, ৭, ৮; ৫:৩-৬.

 ইয়োব কোনোভাবেই তাদের এই যুক্তি মেনে নিতে পারেন না। (ইয়োব ৬:২৫) এরপর, এই তিন জন আরও নিশ্চিত হয়ে যান যে, তিনি নিশ্চয়ই কোনো খারাপ কাজ করেছেন এবং সেটা লুকোনোর চেষ্টা করছেন। তাই তারা বোঝাতে চান, তার প্রতি যা ঘটেছে, এটা হওয়া উচিত ছিল। ইলীফস ইয়োব সম্বন্ধে বলেন যে, তিনি একজন অহংকারী ও মন্দ ব্যক্তি, যার ঈশ্বরের প্রতি কোনো ভয় নেই। (ইয়োব ১৫:৪, ৭-৯, ২০-২৪; ২২:৬-১১) এরপর সোফর বলেন, ইয়োব মন্দ কাজ করা পছন্দ করেন আর তাকে মন্দ কাজ করা বন্ধ করতে হবে। (ইয়োব ১১:২, ৩, ১৪; ২০:৫, ১২, ১৩) শেষে, বিল্‌দদ সবচেয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইয়োবের ১০ জন সন্তান যেভাবে মারা গিয়েছে, তাদের সেভাবেই মারা যাওয়া উচিত ছিল, কারণ তারা নিশ্চয়ই কোনো পাপ কাজ করেছিল!—ইয়োব ৮:৪, ১৩.

ইয়োবের তিন জন মিত্র তাকে কোনোরকম সান্ত্বনাই দিতে পারেননি বরং তারা তাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছিলেন

ইয়োবের বিশ্বস্ততা পরীক্ষার মুখে পড়ে!

 এই ব্যক্তিরা আরও খারাপ কিছু বলতে শুরু করেন। তারা বলতে চান যে, ইয়োব কখনোই ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ততা দেখাননি আর এমনকী ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখানোও বৃথা! ইলীফস যখন কথা বলতে শুরু করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, একজন অদৃশ্য স্বর্গদূতের সঙ্গে তার দেখা হয়। আর সেই মন্দ স্বর্গদূতের সঙ্গে কথা বলার পর তিনি এই উপসংহারে পৌঁছান যে, ঈশ্বর “আপন দাসগণকেও বিশ্বাস করেন না, আপন দূতগণেতেও ত্রুটির দোষারোপ করেন।” কিন্তু আসলে, এই কথাটা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভেঙে ফেলতে পারে! ইলীফসের এই যুক্তি অনুযায়ী কোনো মানুষ ঈশ্বরকে কখনোই খুশি করতে পারে না। আর পরে বিল্‌দদ এই দাবি করেন যে, একটা পোকা যদি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখায়, তা হলে সেটাকে যেমন ঈশ্বর কোনো মূল্য দেবেন না, ঠিক তেমনই ইয়োব যদি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখান, তা হলে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সেটারও কোনো মূল্য নেই!—ইয়োব ৪:১২-১৮; ১৫:১৫; ২২:২, ৩; ২৫:৪-৬.

 আপনি কি কখনো এমন কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যিনি প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে রয়েছেন? এমনটা করা সহজ নয়। আমরা ইয়োবের তথাকথিত মিত্রদের কাছ থেকে এই বিষয়ে অনেক কিছু শিখতে পারি যে, সান্ত্বনা দেওয়ার সময় আমাদের কোন বিষয়গুলো করা এড়িয়ে চলা উচিত। এই তিন জন ব্যক্তি ইয়োবের সামনে অনেক উচ্চ উচ্চ কথা ও যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু তারা এক বারও তার প্রতি কোনো সমবেদনা দেখাননি, তারা এক বারও ইয়োবের নাম উল্লেখ করে তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো কথা বলেননি! ইয়োব যে এত যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন, এই বিষয়টাকে তারা পুরোপুরি উপেক্ষা করেছিলেন। আর তারা তার প্রতি কোনোরকম কোমলতা বা সদয়ভাব, কিছুই দেখাননি। a আমরা যদি দেখি, কোনো ব্যক্তি হতাশার মধ্যে রয়েছেন, তা হলে আমরা যেন তার প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখাই এবং তার সঙ্গে সদয়ভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলি। আমরা যেন সেই ব্যক্তিকে তার বিশ্বাস ও সাহস গড়ে তোলার জন্য সাহায্য করি। এ ছাড়া, যিহোবা যে-সমস্ত মহৎ উপায়ে দয়া, করুণা ও ন্যায়বিচার দেখিয়ে থাকেন, সেগুলোর প্রতি আস্থা বজায় রাখার জন্য আমরা যেন সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করি। ইয়োব যদি তার তিন জন মিত্রের জায়গায় থাকতেন আর তাকে যদি সান্ত্বনা দিতে হত, তা হলে তিনি ঠিক এভাবেই সান্ত্বনা দিতেন। (ইয়োব ১৬:৪, ৫) ইয়োব যখন দেখেন যে, এই তিন জন ব্যক্তি বার বার তার বিশ্বস্ততা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছেন, তখন তিনি কী করেন?

ইয়োব স্থির থাকেন

 ইয়োবের মিত্রেরা যখন কথা বলতে শুরু করেছিলেন, তার আগে থেকেই তিনি অনেক কষ্টের মধ্যে ছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি মেনে নেন যে, তার কথাগুলো কখনো কখনো ‘অসংলগ্ন বাক্য’ এবং ‘নিরাশ ব্যক্তির বাক্যের’ মতো ছিল। (ইয়োব ৬:৩, ২৬) কেন তিনি এই ধরনের কথা বলেন? একটা কারণ হল তিনি প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে ছিলেন, তিনি নিরাশ এবং হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আরেকটা কারণ হল তার প্রতি এগুলো কেন ঘটছে, তা তিনি সম্পূর্ণভাবে জানতেন না। ইয়োব ও তার পরিবারের উপর হঠাৎই এত সমস্যা নেমে এসেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন এগুলো অলৌকিক উপায়ে হয়েছে। তাই, তিনি এমনকী মনে করেন, যিহোবাই হয়তো এগুলো ঘটিয়েছেন। এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল, যেগুলো সম্বন্ধে ইয়োব কিছুই জানতেন না। তাই, তার এই ভুল ধারণা ছিল।

 কিন্তু, ইয়োব যিহোবার উপর পূর্ণ বিশ্বস্ততা দেখান। তার যে বিশ্বাস রয়েছে, সেটা আমরা তার কথার মাধ্যমে জানতে পারি। যখন তিনি তার মিত্রদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তার কথাগুলো যদি আমরা লক্ষ করি, আমরা দেখতে পারব যে, তার কথাগুলো খুবই সুন্দর, সত্য এবং আমাদের জন্য উৎসাহজনক। ইয়োব যখন অপূর্ব সৃষ্টি সম্বন্ধে কথা বলেছিলেন, তখন তিনি ঈশ্বরের মহিমা করেছিলেন। তিনি এমন কথা বলেছিলেন, যেগুলো ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়া কোনো মানুষই বলতে পারত না। যেমন তিনি বলেছিলেন, যিহোবা “অবস্তুর উপরে পৃথিবীকে ঝুলাইয়াছেন।” (ইয়োব ২৬:৭) এই তথ্যটা বৈজ্ঞানিকরা শত শত বছর পর জানতে পেরেছিল। b ইয়োব যখন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার আশা নিয়ে কথা বলেছিলেন, তিনি এই বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন যে, তিনি যদি মারাও যান, তবুও ঈশ্বর তাকে মনে রাখবেন এবং অবশ্যই একসময় তাকে জীবিত করবেন। অন্যান্য বিশ্বস্ত ব্যক্তিরাও ঠিক এমনটাই আশা করেছিল।—ইয়োব ১৪:১৩-১৫; ইব্রীয় ১১:১৭-১৯, ৩৫.

 বিশ্বস্ততার বিষয়ে যে-প্রশ্ন উঠেছিল, সেটার ব্যাপারে কী বলা যায়? ইলীফস ও তার দুই মিত্র জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, মানুষ যে-বিশ্বস্ততা দেখিয়ে থাকে, সেটাকে ঈশ্বর কোনো মূল্য দেন না। ইয়োব কি এই মন্দ চিন্তাভাবনা মেনে নিয়েছিলেন? একেবারেই নয়! তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ঈশ্বর মানুষের বিশ্বস্ততাকে খুবই মূল্যবান হিসেবে দেখেন। তিনি বলেছিলেন: যিহোবা “জানতে পারবেন যে, আমি নির্দোষ [“বিশ্বস্ত,” NW]।” (ইয়োব ৩১:৬, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারশন) এ ছাড়া, ইয়োব বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার এই তিন জন মিত্র তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার নামে আসলে তার বিশ্বস্ততার উপর এক বড়ো পরীক্ষা নিয়ে আসছেন। ফলে, তিনি এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যেগুলো একেবারের জন্য তার মিত্রদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল।

 ইয়োব বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি দৈনন্দিন জীবনে যা-কিছু করতেন, সেগুলোর সঙ্গে তার বিশ্বস্ততা জড়িত রয়েছে। তাই, তিনি তার মিত্রদের বলেছিলেন, তিনি যা-কিছু করতেন, সব ক্ষেত্রেই তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি কোনো উপায়েই প্রতিমাপূজা করতেন না। তিনি অন্যদের সঙ্গে সদয়ভাবে এবং সম্মান দেখিয়ে আচরণ করতেন। তিনি নৈতিক দিক দিয়েও শুদ্ধ ছিলেন, তিনি তার বিয়েকে খুবই মূল্যবান হিসেবে দেখতেন। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় হল, তিনি একমাত্র সত্য ঈশ্বর যিহোবার প্রতি অনুগত ছিলেন। তাই, ইয়োব পূর্ণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন: “প্রাণ থাকিতে আমি আপন সিদ্ধতা [“বিশ্বস্ততা,” NW] ত্যাগ করিব না।”—ইয়োব ২৭:৫; ৩১:১, ২, ৯-১১, ১৬-১৮, ২৬-২৮.

অনেকেই ইয়োবের বিশ্বস্ততা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ইয়োব দৃঢ়ভাবে তার বিশ্বস্ততা ধরে রেখেছিলেন

ইয়োবের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

 আপনিও কি বিশ্বস্ততা দেখানোকে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, যতটা ইয়োব মনে করতেন? আমাদের মনে হতে পারে যে, বিশ্বস্ততা দেখানো খুবই সহজ। কিন্তু, ইয়োব বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিশ্বস্ততা শুধু কথায় নয় বরং আমাদের কাজের দ্বারাও প্রমাণ করতে হবে। আমরা যখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, এমনকী কষ্টের সময়ও, ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য হই এবং তাঁর দৃষ্টিতে যা সঠিক, তা করি, তখন আমরা ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ ভক্তি দেখাতে পারব। আমরা যখন এমনটা করব, তখন আমরা যিহোবাকে খুশি করব এবং তাঁর শত্রু শয়তানকে ভুল বলে প্রমাণিত করব, ঠিক যেমনটা ইয়োব করেছিলেন। এটাই হল ইয়োবের বিশ্বাসকে অনুকরণ করার সবচেয়ে ভালো উপায়!

 তবে, ইয়োবের কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যায় না। কিছু সময়ের জন্য তিনি ভুল চিন্তাভাবনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন কারণ তিনি এই বিষয়টা প্রমাণ করার জন্য বেশি প্রচেষ্টা করেছিলেন যে, তিনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি। সেইসময় তিনি ঈশ্বরের সুনাম রক্ষা করার বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলেন। ইয়োবের সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, যেন তিনি আবারও বিভিন্ন বিষয়কে যিহোবার মতো করে দেখতে পারেন। ইয়োব এখনও প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে ও শোকের মধ্যে রয়েছেন। তার এমন ব্যক্তির কাছ থেকে সান্ত্বনার প্রয়োজন, যিনি প্রকৃতই তাকে মন থেকে সান্ত্বনা দেবেন। এই বিশ্বস্ত পুরুষের জন্য যিহোবা কী করবেন? আসুন, আমরা এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের পরবর্তী প্রবন্ধে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেখি।

a অবাক করার মতো বিষয় হল ইলীফস এবং তার মিত্রেরা ভেবেছিলেন যে, যেহেতু তারা খুব নীচু গলায় ইয়োবের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাই তাদের কথা মনে হয় খুবই সান্ত্বনাজনক। (ইয়োব ১৫:১১) কিন্তু, এমনকী নীচু গলায় বলা কোথাও আঘাত দিতে পারে এবং সেই কথা খুবই নিষ্ঠুর হতে পারে।

b এর প্রায় ৩,০০০ বছর পর বৈজ্ঞানিকরা এই বিষয়টা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, পৃথিবীর কোনো বস্তুর উপর থাকার প্রয়োজন নেই। পরে যখন মহাকাশ থেকে বিভিন্ন ছবি তুলে আনা হয়েছিল, তখন লোকেরা এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, ইয়োব এখানে যে-কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো সত্য।